নতুন উদ্যোক্তা কেন পার্সোনাল ব্রান্ডিংকে গুরুত্ব দিবে?

আচ্ছা পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং কি এবং কিভাবে করে বিস্তারিত জানার আগে চলুন একটা গল্প পড়ি।

আয়মান এবং আহনাফ কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়া দুই বন্ধু। দুইজনই গ্রাফিক্স ডিজাইনিং নিয়ে অনেক আগ্রহী । কিন্তু আয়মান আহনাফ এর তুলনায় এতে বেশ পারদর্শী।

আয়মানের ফেসবুকের কভার পিকচারে তার নিজের ডিজাইন করা একটা অ্যানিমেশনের ছবি দেয়া। এই ছবি দেখেই সবাই আয়মানের কাজের ধরন আঁচ করে ফেলতে পারে। সে তার বিভিন্ন কাজের ছবি প্রায়ই আপলোড করে। তার বেশিরভাগ পোস্টও একে কেন্দ্র করেই।

আয়মানের ফলোয়ারের সংখ্যা তেমন বেশি না কিন্তু ডিপার্টমেন্টের যেকোনো কাজের জন্য প্রায়ই তার ডাক পড়ে। সিনিয়র ও শিক্ষকদের মাঝে তার বেশ সমাদর।

অপরদিকে আহনাফের হাজারখানেক ফলোয়ার। ফেসবুকে সে খুবই অ্যাক্টিভ আর ডিপার্টমেন্টেও খুব পরিচিত। কিন্তু আয়মানের মতো কাজের বেলায় তাকে কখনো ডাকা হয় না।

উপরের দুই বন্ধুর গল্পেই একটা জিনিস লক্ষণীয়, তা হচ্ছে, এরা দু’জনই করছে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং। কিন্তু দু’জনের প্রক্রিয়াটা কি সঠিক? দু’জনই কি এর থেকে সমান ভাবে উপকৃত হবে? এসবের উত্তরের জন্য প্রথমেই জানতে হবে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং কী।

পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং কী?
প্রতিযোগিতার এই যুগে অনলাইন বিজনেস করতে এসে প্রতিনিয়ত আমরা নতুন যে শব্দগুলো শুনে থাকি তার মাঝে বহুল প্রচলিত হচ্ছে, Personal Branding। ব্র্যান্ডিং শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আক্ষরিক অর্থে ব্র্যান্ডিং হল যেকোনো ব্যবসা বা পণ্যকে স্বকীয়তা বা নিজস্বতা প্রদান করে এমন চিহ্ন।

তবে এখন ব্র্যান্ডিং বলতে শুধু ব্যবসাকে স্বকীয়তা প্রদান করাই বোঝায় না। বরং এই স্বকীয়তাকে মানুষের সামনে ফুটিয়ে তোলা এবং তা বজায় রাখার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকেই বোঝানো হয়। কিন্তু পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং? সে আবার কী? নিজেকে নিজে আবার কিভাবে ব্র্যান্ডিং করব? এসব প্রশ্নের উত্তরই আমরা এখন জানব!

Personal Branding আপনাকে আপনার সামর্থ্য, প্যাশন এবং দক্ষতা তুলে ধরার সুযোগ দেয়। এর মাধ্যমে আপনি সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সামনেও নিজেকে বিশ্বস্ত হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন।

এ কারণে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী এমনকি আর্টিস্টদের জন্যও Personal Branding খুবই দরকারি।

নতুন উদ্যোক্তা কেন করবে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং?
Personal Brand তৈরির অনেক কারণ আছে। তবে বিশেষ ভাবে বলতে গেলে কয়েকটা কারণ বলা বাঞ্ছনীয়ঃ

কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিজেকে “গো-টু পার্সন” হিসেবে পরিচিত করতে চাইলে- ধরুন, আপনি কোনো বিষয়ে বিশেষভাবে পারদর্শী। আর আপনি চান ঐ বিষয়ে কারো কোনো প্রয়োজনে সবার আগে আপনার কথাই মাথায় আসুক। এমনটা চাইলে আপনি মানুষকে আপনার দক্ষতা সম্পর্কে জানাতে হবে। আর এর জন্য আপনাকে একটি শক্তিশালী Personal Brand তৈরি করতে হবে। আপনার Personal Brand আপনাকে অন্য সবার থেকে আলাদা হতে সহায়তা করবে।

নিত্যনতুন সুযোগ পাওয়ার জন্য-

একটি শক্তিশালী Personal Brand আপনার জন্য প্রচুর পরিমাণে সুযোগ তৈরি করবে, যার মধ্যে রয়েছেঃ

➡️জব ইন্টারভিউ

➡️ইন্টার্নশীপ

➡️স্পিকিং এঙ্গেজমেন্ট

➡️নেটওয়ার্কিং

➡️পদোন্নতি

➡️পার্টনারশিপ

আপনার Personal Brand হল ইটের মতো; এটি ভিত্তি গেড়ে আপনাকে ভবিষ্যতের বড় সাফল্যের দিকে পরিচালিত করবে। ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উভয় লক্ষ্যেই পৌঁছাতে সহায়তা করবে এবং ক্যারিয়ারে অগ্রগতির অনেক সুযোগ সঞ্চার করবে।

👉বিভিন্ন উপায়ে, আপনার Personal Brand আপনাকে স্মরণীয় করে তোলে। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে কোনো একটা বিষয়ে আপনি একমাত্র দক্ষ হবেন, এমনটা কল্পনাও করা যায় না। Personal Brand আপনাকে একই বিষয়ে দক্ষ হাজার হাজার মানুষ থেকে পৃথক হতে সহায়তা করে। Personal Brand আপনাকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে, একটি নির্দিষ্ট দক্ষতার কথা শুনলেই সবার আপনার কথা মাথায় আসবে।আপনার কি কি কাজে লাগবে পার্সোনাল ব্রান্ড? দেখুন—

➡️নিজের মাধ্যমে পণ্যের ব্র‍্যান্ডিং করতে

➡️নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রসারের জন্য

➡️সর্বোত্তম প্রথম ইম্প্রেশনের জন্য

বর্তমানে শুধুমাত্র চাকরির ক্ষেত্রে নয়, বরং যে ক্ষেত্রেই মানুষ আপনার নাম প্রথমবারের মত শুনবে, সর্বপ্রথম সে যে কাজটি করবে তা হল, ফেসবুক কিংবা গুগলে আপনার নাম সার্চ দেয়া। আমরা জানি “First impression is the last impression”। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনি দেখা করে কাউকে আপনার ফার্স্ট ইম্প্রেশন দিতে পারবেন না। সে পূর্বেই আপনার অনলাইন অ্যাক্টিভিটি থেকে ফার্স্ট ইম্প্রেশন নিয়ে নিবে।

কীভাবে অনলাইন প্রেজেন্স পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং-এ প্রভাব ফেলে?

যেমনটা মাত্র বললাম, বর্তমান যুগে মানুষ কারো সাথে কথা বলার আগেই ইন্টারনেটে তাকে খোঁজে এবং সেখান থেকে অনুমান করার চেষ্টা করে মানুষটা কেমন হবে। গবেষণা দেখায়, কমপক্ষে ৮০% লোক কেনাকাটা করার আগে অনলাইনে গবেষণা করে

তাই ভালো পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং এর জন্য অনলাইন প্রেজেন্সের বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি।

একজন নতুন উদ্যোক্তা কীভাবে তৈরি করবেন পার্সোনাল ব্র্যান্ড?

খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, অনলাইনে একটা থিম ঠিক করুন, আপনি কী হিসেবে নিজেকে পরিচিতি দিতে চান তা ঠিক করুন। যেকোনো রকমের পোস্ট দেয়ার সময় তা থিমের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে দিন। এ ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ গুলো নিতে পারেন–

আপনার দক্ষতার ক্ষেত্রটি চিহ্নিত করুন।

আপনার সামাজিক মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলি সম্পূর্ণ আপডেট করুন

বিগত বছরগুলোর বিতর্কিত পোস্ট সরিয়ে ফেলতে পারেন যা আপনার পেশাদার জীবনের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।

নিয়মিতভাবে পোস্ট শেয়ার করুন।

বর্তমানে ট্রেন্ডে আছে এমন বিষয়ে পোস্ট করার চেষ্টা করুন সবসময়। তবে অবশ্যই বিষয়টা নিয়ে ভালমতো জেনে।

অন্যের প্রদত্ত পোস্ট পুনরায় পোস্ট করার চেয়ে নিজের লিখিত বা তৈরিকৃত পোস্ট শেয়ার করুন, যা আপনার Personal Brand এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

মাঝে মাঝে নিজের অর্জন সম্পর্কেও কথা বলুন। এমনকি আপনার ব্যক্তিগত জীবন (যেমন ভ্রমণ, শখ ইত্যাদির মতো উপযুক্ত বিষয়গুলি) নিয়ে আকর্ষণীয় পোস্ট করুন। এ ধরনের পোস্ট মানুষকে আপনি কী ধরনের মানুষ তা বুঝতে সাহায্য করে।

সোশ্যাল মিডিয়া ইতিবাচক রাখুন।বিতর্কিত পোস্ট এড়িয়ে চলুন এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কথাবার্তা বুঝেশুনে বলুন যাতে করে আপনার Personal Brand আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট আলাদা রাখুন।

বাছাইকৃত কিছু গ্রুপে যোগদান করুন।আপনার নির্দিষ্ট দক্ষতার ক্ষেত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গ্রুপগুলোতে যোগ দিন কারণ এগুলো আপনার টার্গেটেড অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছানোর জন্য বেশ ফলপ্রসূ হতে পারে।

অফলাইন Personal Branding!
একজন নতুন উদ্যোক্তার জন্য অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনে ও পার্সোনাল ব্রান্ডিং টাও সামান গুরুত্বপূর্ণ। তাই অনলাইন ব্র্যান্ডিং-এ ফোকাস করে অফলাইন জগতটিকে ভুলে যাবেন না। আপনার Personal Branding এর জন্য এমন সমস্ত জায়গা মাথায় রাখা আবশ্যক যেখানে আপনার কাস্টমাররা আপনার মুখোমুখি হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট আপনার ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আপনার ট্রেডিশনাল ব্যবসায়িক কার্ড। খেয়াল রাখবেন যেন সবকিছুতে সামঞ্জস্যতা বজায় থাকে।

আপনি যেখানেই যান আপনার সাথে ব্যবসায়িক কার্ড বহন করুন। এটি এখনো তেমনই প্রাসঙ্গিক যেমনটা চল্লিশ বছর আগে ছিল। যখনই আপনি আপনার সম্ভাব্য কাস্টমারের সাথে নেটওয়ার্কিং করার সুযোগ দেখবেন তখন একটি কার্ড বের করুন।

অবশ্যই আপনি চাইবেন যাতে আপনার Personal Brand আপনার জীবন যাপনের ধরনকে পুরোপুরিভাবে উপস্থাপন করে তাই পোশাকও সেভাবেই বাছাই করুন। ধূসর রঙ্গের টিশার্ট দেখলেই যেমন মার্ক জাকারবার্গের কথা মনে পড়ে এবং সেই সাথে এও মনে পড়ে যায় যে, বিলিওনিয়ার হলেও তার জীবনটা একদম সাদামাটা। এভাবে করে যেমন জাকারবার্গের পোশাকই তার ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে তেমনি আপনার পোশাকও যেন এমন একটি বার্তাই প্রদান করে যা আপনাকে এক শব্দে বিশ্লেষণ করতে পারে।

পরিশেষে…

Personal Branding ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে। এই বিষয় নিয়ে অনেক বছর ধরে কাজ করা বিশেষজ্ঞরাও বলেন, Personal Branding-এর কোনো শাশ্বত নিয়ম নেই। তবে উপরে আলোচিত বিষয়গুলো মাথায় রাখলে Personal Branding অনেক সহজ হয়ে যায় আর এর কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

আমি আঞ্জুয়ারা খাতুন,একজন উদ্যোক্তা ও মাডারেটর বিজ্ঞপ্তিবাজার ইসলামী ইকমার্স & কনসালটেন্সি। সিজনাল ও ট্রেডিশনাল প্রডাক্ট নিয়ে কাজ করি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top