ইসলামে হালাল রুজি ও বিজনেসের গুরুত্ব

ফরজ ইবাদতসমূহের (নামায, রোযা, যাকাত ইত্যাদি) পরে হালাল উপার্জন করাও একটি ফরজ। এটি ইবাদতের গুরুত্ব রাখে। কেননা জীবন-যাপনে সঙ্কীর্ণতা ও অন্যের দ্বারস্থ হওয়া ইজ্জত-সম্মানের জন্য কলঙ্ক।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন— ‘মানুষ নিজ হাতে উপার্জন করে যা খায় তা-ই সর্বোত্তম খাবার। নবী দাউদ (আ.) ও নিজ হাতের উপার্জন খেতেন।’ (সহিহ বুখারি)

ব্যবসা করা মহৎ পেশা। ইসলামি শরিয়ত ব্যবসাকে হালাল করেছে। এবং এটি উপার্জনের সর্বোত্তম মাধ্যম বলে আখ্যা দিয়েছে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন উপার্জন সবচেয়ে উত্তম? নবীজি বললেন, বরকতময় ব্যবসা ও পুরুষের হাতের উপার্জন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৫৮৩৬)। এই হাদিসে বরকতময় ব্যবসা বলে ধোঁকা, প্রতারণা মুক্ত ব্যবসা বুঝানো হয়েছে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে ব্যবসা করেছেন। অন্যান্য অনেক নবী (আ,)ও ব্যবসা করেছেন। অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম ব্যবসা করেছেন। ব্যবসার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর নানা প্রান্তে গিয়েছেন। ব্যবসার পাশাপাশি তাঁরা প্রচার করেছেন ইসলামের অমীয় বাণী। এমনকি ব্যবসার উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কেরাম এ অঞ্চলেও আগমন করার বর্ণনা পাওয়া যায়।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ:
ইসলাম বৈধ পন্থায় রিজিক অনুসন্ধান করাকে উত্তম দৃষ্টিতে দেখে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমু‘আ, আয়াত : ১০)
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে— নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হালাল ধনসম্পদ অনেক উত্তম জিনিস।’ (মুসনাদে আহমদ)

ব্যবসা-বাণিজ্যের ফজিলত ও মৌলিক উদ্দেশ্য:
সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিনে নবীগণ সিদ্দিকগণ এবং শহীদগণের দলে থাকবেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১২০৯)
অন্য হাদিসে এসেছে— ‘পেশাদার মুসলমানকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন।

ব্যবসার উদ্দেশ্য শুধু মুনাফা অর্জন নয় বরং এর দ্বারা মানুষের সঙ্গে পরিচিতি বাড়বে। এসব ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, আন্তরিকতা দেখানো এবং হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বলা উচিত। তাহলে ইসলামের সৌন্দর্য অন্যদের কাছে তুলে ধরা সহজ হবে। এবং নিজের ব্যপারেও অন্যদের অন্তরে ইজ্জত-সম্মান এবং ভালোবাসা ঠিক থাকবে। তখন লোকজন কোনো কথা সহজেই গ্রহণ করবে। যা দ্বীনের দাওয়াতে একজন মুসলমানকে সহায়তা করবে। তাছাড়া শরিয়া মোতাবেক ব্যবসা-বাণিজ্য করলে আল্লাহ তায়ালা রিজিকে বরকত দান করবেন।

ব্যবসায় শরিয়তের মূলনীতি:
ব্যবসা করতে হবে ইসলামের মূলনীতি বজায় রেখে। ইসলাম ব্যবসায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে। ব্যবসার ক্ষেত্রে সততা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ক্রেতাকে ঠকানো, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য সরবরাহ করা, অধিক মূল্য নির্ধারণ করা, ওজনে কম দেওয়া, গুদামজাত করে মূল্যবৃদ্ধি করা, প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষককে তার উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। পাশাপাশি প্রয়োজনে বিক্রীত পণ্য ফেরত নেওয়ার ফজিলতও ইসলাম বয়ান করেছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন— ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করো তা বৈধ।’ (সুরা নিসা : ২৯)

কোরআন-হাদিসে সৎ ব্যবসায়ীর মর্যাদা ও ফজিলত যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, অনুরূপ অসৎ উপায়ে যারা ব্যবসা করে তাদের ব্যপারে কঠিন হুশিয়ারি এসেছে।

হযরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির সঙ্গে আল্লাহ তায়াল কেয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি এটা তিনবার পাঠ করলেন।’ আবু যর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা হলো যে ব্যক্তি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরে, যে ব্যক্তি দান করে খোটা দেয় এবং যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০৬)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ধোঁকা দেয় ও প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)

ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে ই-কমার্স:
বর্তমান যুগ তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। ইন্টারনেটের কল্যাণে ঘরে বসে অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ের এক নতুন দ্বারের উন্মোচন হয়েছে। আধুনিক প্রজন্মের কাছে ই-কমার্স একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। ইন্টারনেট ব্যবহার করে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, অর্থ লেনদেন ও ডাটা আদান-প্রদানই হচ্ছে ই-কমার্স বা ই-বাণিজ্য।

তবে ই-কমার্সে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, লেনদেন এবং অর্থ পরিশোধের বিষয়ে ইসলামের সতর্ক অবস্থানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেহেতু ই-কমার্স হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি নতুন সংস্করণ, সুতরাং তা অবশ্যই ইসলামি নীতিমালা অনুযায়ী হতে হবে, শরিয়া কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।

ই-কমার্স জায়েয-নাজায়েয (গ্রহণীয় বা বর্জনীয়) হওয়ার ব্যাপারে প্রধান দু’টি মূলনীতি রয়েছে।
(১) পণ্য ও উপাদান বৈধ হতে হবে। অবৈধ পণ্যের কারবার বা ব্যবসা গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন মদ, জুয়া, সূদ ইত্যাদি। কারণ এসব বিষয় মৌলিকভাবে ইসলামে হারাম।
(২) লেনদেন সর্বাবস্থায় বৈধ পন্থায় হতে হবে। অর্থাৎ সেখানে কোন ধরনের ধোঁকাবাজি, ভেজাল ও ফাঁক-ফোকর থাকতে পারবে না। কোন ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না।

সাথে সাথে হালাল পণ্যে যদি নিম্নোক্ত দু’টি শর্ত পাওয়া যায় তবে অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয় জায়েয।
প্রথমত : যে পণ্যে বিক্রি করবে তার পূর্ণ মালিকানা বিক্রেতার থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন— ‘যা তোমার কাছে নেই তা বিক্রি করো না’।
তবে যদি বিক্রেতার কাছে উপকরণ সমূহ পূর্ণ মাত্রায় থাকে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে তাহলে পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া বৈধ হবে।
দ্বিতীয়ত : পণ্যটি স্পষ্ট হতে হবে। অর্থাৎ যে পণ্যটি বিক্রয় করা হবে সেটির গুণ, পরিমাণ সহ বিস্তারিত বর্ণনা থাকতে হবে। কোন কিছু গোপন করা অথবা অস্পষ্ট রাখা যাবে না।

সন্দেহের অবকাশ থাকায় ই-কমার্সের একমাত্র বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে অর্থ পরিশোধ করার পদ্ধতি। সন্দেহের বিষয় হলো– অর্থ পরিশোধ ইসলামি পদ্ধতিতে হচ্ছে কী না?

ই-কমার্সে অর্থ লেনদেনের বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে।
মোবাইল ব্যাংকিং ও ডেবিট কার্ড: সাধারণত এটি ব্যবহার করে বেচা-কেনা করতে ইসলামের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্ত যদি কারো একাউন্টে সূদের টাকা জমা থাকে তাহলে সেই টাকা দিয়ে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় জায়েয হবে না।
ক্রেডিট কার্ড : অর্থ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রচলিত ক্রেডিট কার্ড পদ্ধতি ব্যবহার করা অধিকাংশ মুফতিগণ নিষেধ করেছেন। কেননা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে পণ্যের অর্থ পরিশোধ করার অর্থ হচ্ছে, সূদে ঋণ নিয়ে সেই টাকায় পণ্যের অর্থ পরিশোধ করা।

উপরোল্লিখিত শর্তগুলো মৌলিকভাবে প্রত্যেক ব্যবসার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ই-কমার্স পদ্ধতি নতুন হওয়ায় আলাদাভাবে উল্লেখ করা হলো।

ইসলাম কখনোই শিল্প, সভ্যতা এবং প্রযুক্তি বিকাশের অন্তরায় ছিল না। বরং সর্বদা সহায়ক ছিল। তাই ইসলাম ই-কমার্সকে কখনোই নিরুৎসাহিত করে না। তবে যেসব কারণে ই-কমার্স হারাম হয় সেগুলো পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে।
বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন মানুষ মুসলমান। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের এ নতুন সংস্করণ ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া সময়ের দাবী। এ বিষয়ে মুসলিম গবেষকদেরও সক্রিয় হওয়া জরুরী। যাতে করে ই-কমার্স থেকে সূদের অনুপস্থিতি এবং অবৈধ তথা হারাম পণ্য থেকে বেঁচে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।

আমাদেরকে বিজনেস করতে হবে শরিয়তের মানসা ও হুকুম অনুযায়ী। এক্ষেত্রে ত্রুটি বা কমতি নিন্দনীয়। ধোঁকা-প্রতারণা থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকতে। নিজের সাধ্যানুযায়ী সবারই উচিৎ হালাল ভাবে বিজনেসে জড়িত থাকা। তাহলে রিজিকে বরকত পাওয়া যাবে। এবং উপরোল্লিখিত হাদিসের মর্যাদা লাভ করে আখেরাতে অশেষ সম্মানের অধিকারী হওয়া সম্ভব হবে।

একটি মহৎ লক্ষ্য সামনে রেখে বিজ্ঞপ্তিবাজার ইসলামী ই-কমার্স & কনসালটেন্সি– এর সূচনা এবং আয়োজন। বিজ্ঞপ্তিবাজার ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে শুরু হলেও স্বপ্ন দেখে বড় কিছুর। মানুষকে হালাল ব্যবসায় অভিমুখী করা এর প্রধান একটি উদ্দ্যশ্য। বিজ্ঞপ্তিবাজার ইসলামী ই-কমার্স & কনসালটেন্সি সবার জন্য, মানুষ ও মানবতার জন্য। ইনশাআল্লাহ এটি প্রচলিত অর্থনীতিতে ইসলামি নিয়মাবলির প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশে ইসলামি অর্থনীতির জাগরণে ভূমিকা রাখবে। আমরা সে আশা-ই রাখি।

মাহদী হাসান চৌধুরী,তরুণ আলেম ও লেখক।ফাজিলঃজামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ ঢাকা-১২১৭

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top